শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:৩১ অপরাহ্ন
ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে, কালের খবর :
এক সময় চালকের সহকারী ছিল সিলেটের আলতাফ হোসেন। টেম্পোতে হেলপারি করে জীবন চালিয়েছেন। কিন্তু গত ৬ থেকে ৭ বছরে সিলেটে অবৈধ সিএনজি-অটোরিকশায় টোকেন বাণিজ্যের মাধ্যমে দু’হাতে টাকার মালিক বনেছেন তিনি। পরিবহন সেক্টরে এক নামেই চিনেন সবাই। চোরাই সিএনজি, বহিরাগত জেলার গাড়ি, সিলেটের অন টেস্ট সিএনজি-অটোরিকশার টোকেন বাণিজ্যের মাধ্যমে চালাতেন। সিলেট দক্ষিণের উপজেলার দক্ষিণ সুরমা, বিশ্বনাথ, ওসমানীনগর, বালাগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার ও জকিগঞ্জের সব অবৈধ গাড়ি সড়কে চলে তার কথায়। ৫ই আগস্ট প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পর তার টোকেন বাণিজ্যে ভাটা পড়েছে। আর সাম্প্রতি সময় সিলেট মেট্রো পুলিশ অবৈধ ধরপাকড় শুরু করার কারণে আলতাফের বাণিজ্যে পুরোপুরি ধস নেমে আসে। এই অবস্থায় সিলেটের সিএনজি-অটোরিকশা শ্রমিকদের ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা করছেন তিনি। বিভিন্ন উপ-কমিটির নেতাদের দিয়ে প্রশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন বলে জানিয়েছেন বৈধ সিএনজি-অটোরিকশার শ্রমিকরা। আলতাফ মাসে কতো টোকেন বাণিজ্য করেছে? এ প্রশ্নের উত্তরের সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে শ্রমিক নেতারা গত সপ্তাহে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে বৈঠকে বলেছেন; হাজার হাজার অবৈধ সিএনজি- অটোরিকশা সিলেট দক্ষিণের উপজেলাগুলোতে চলছে। তারা জানিয়েছেন- এর সংখ্যা কম হলেও ৫ হাজার হবে। বিআরটিএ থেকে নতুন গাড়ির অনুমোদন দেয়া বন্ধ থাকার কারণে টোকেন বাণিজ্যের মাধ্যমে এসব সিএনজি-অটোরিকশা সিলেট নগরে চলছে। এ কারণে নগরের যানজট তীব্র হচ্ছে। শ্রমিক নেতারা পরিসংখ্যান তুলে ধরে মানবজমিনকে জানিয়েছেন- যদি ৫ হাজার অবৈধ সিএনজি চলে তাহলে মাসে প্রতিটি সিএনজি থেকে টোকেনের বিনিময়ে ১ হাজার টাকা দেয়া হয়। আর টোকেন দিয়ে টাকা উত্তোলন করতো আলতাফ হোসেন। এতে প্রতি মাসে প্রায় ৫০ লাখ টাকার টোকেন বাণিজ্য করা হয়। এই টাকার অর্ধেক অংশ পুলিশ প্রশাসনের ট্রাফিক বিভাগের একটি সিন্ডিকেটের কাছে যেতো। আর অর্ধেক টাকার সিংহভাগ আলতাফ নিয়ে নেয়। কিছু অংশ পরিবহন শ্রমিকদের শীর্ষ নেতাদের কাছেও যায়। আলতাফের সহকর্মী সিএনজি- অটোরিকশা চালকরা জানিয়েছেন- পেছনে পুলিশের ছায়া থাকায় সিলেটের সিএনজি-অটোরিকশা সেক্টরে মূর্তিমান আতঙ্কের নাম আলতাফ হোসেন। তার দাপটের কাছে খোদ থানার ওসিরাই অসহায় ছিলেন। তার দেয়া টোকেন সড়কে ছিল বৈধ। প্রকাশ্যে গাড়িতে স্থাপন করা হতো তার টোকেন। আর এই টোকেন দেখলে থানা পুলিশ ও ট্রাফিক বিভাগ কেউই গাড়ি ধরতো না।
জকিগঞ্জে বাড়ি আলতাফের। অনেক আগে সে জীবিকার সন্ধানে সিলেটে এসেছিল। দক্ষিণ সুরমায় তখনকার সময় টেম্পো-অটোরিকশা চালক জমসেদের হেলপার ছিল। পরে সে নিজেই ড্রাইভার হয়েছে। ২০১৫ সাল পর্যন্ত আলতাফ নিজেও সিএনজি অটোরিকশা চালক ছিল। এরপর সে টোকেন বাণিজ্যের রাজা হয়ে ওঠায় আর গাড়ি চালায়নি। বিভিন্ন এলাকা থেকে চুরি করে নিয়ে আসা অর্ধশতাধিক চোরাই গাড়ির মালিক সে। এ ছাড়া সিএনজি-অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের কয়েকজন নেতার গাড়িও অবৈধভাবে তার নিয়ন্ত্রণে চলে। দক্ষিণ সুরমার ভার্থখলা পাম্পের পাশে অফিসে বসে সিলেট জেলা অর্ধেক সিএনজি-অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণ করে। টাকার লেনদেন সব হয় ওখানে বসেই। এতে দেখা গেছে মাসে মাসে বড় অঙ্কের টাকা গেছে আলতাফের পকেটে। প্রায় চার বছর আগে আলতাফ নগরের বদিকোনা এলাকায় জমি কিনে। এখন সেখানে বহুতল বাসা নির্মাণ করেছে। টোকেনের টাকায় এই বাসার মালিক হয়েছেন তিনি। এ ছাড়া নামে-বেনামে আরও সম্পত্তির মালিক এখন সে। প্রতি মাসে টোকেন বাণিজ্যের মাধ্যমে তার ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা কামাই হয়েছে। এ ছাড়া জকিগঞ্জে গ্রামের বাড়িতে জমি কিনেছেন বলে জানিয়েছেন তার এক সময়ের সহকর্মী-চালকরা। তারা জানিয়েছেন- টোকেন বাণিজ্যই আলতাফের মূল ধান্দা। যেসব চালকরা তার টোকেন না নিয়ে সড়কে চলতেন তাদের গাড়ি পুলিশ দিয়ে আটকানো হতো। চালক ও সিএনজি’র মালিককে নানাভাবে হয়রানি করা হতো। পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ জানিয়েছে; সিলেটে অবৈধ সিএনজি-অটোরিকশাই হচ্ছে যানজটের অন্যতম কারণ। এ কারণে পুলিশের পক্ষ থেকে জেলা ও নগরের সিএনজি পৃথক করার প্রক্রিয়া বহুদিন ধরে চলছে। সম্প্রতি নগর পুলিশের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে জোরালো কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। এতে নগরের যানজট কমে আসছে বলে জানিয়েছেন ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তারা। কিন্তু পরিবহন শ্রমিকরা জানিয়েছেন- আলতাফ এখন শ্রমিকদের ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা করছেন। আলতাফ ও তার সহযোগী শ্রমিকরা ক্ষোভ দেখিয়ে পুলিশের কার্যক্রমকে বাধা প্রদান করতে চাইছে। সঙ্গে যোগ দিয়েছেন কিছু চোরাই ও বহিরাগত জেলার গাড়ির ব্যবসায়ীরা। এ নিয়ে বৈধ অটোরিকশা শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। এ ব্যাপারে আলতাফ হোসেন গতকাল বিকালে জানিয়েছেন ; তিনি কখনো টোকেন বাণিজ্যে ছিলেন না। কখনো করেননি। তার বিরুদ্ধে অযথা অপপ্রচার করা হচ্ছে। তবে; নগরের বদিকোনা এলাকায় তার জমি ও বাড়ি তৈরির কথা স্বীকার করেছেন। তবে টাকার উৎস সম্পর্কে তিনি স্পষ্ট কিছু না জানাতে পারেননি।